0Shares
যদ্দিন মানুষ মরবো তদ্দিন আমরা আছি
….লাশকাটাঘরে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের ‘পরে… জীবনানন্দের লাশকাটাঘরের লাশ টেবিলের ওপর ক্লান্তিহীনভাবে যতই ঘুমাক না কেন; লাশকাটাঘরের মানুষ কিংবা লাশের আপনজনেরা কিন্তু ক্লান্তিহীন নয়; তাই লাশকাটাঘরে লাশ পৌঁছার পরপরই শুরু হয় এক ক্লান্তিকর কর্মচাঞ্চল্য। দুটি পক্ষ। একপক্ষে লাশের আপনজনেরা কিংবা যারা লাশ নিয়ে আসে, অন্যপক্ষে যে লাশ কাটবে এবং তার সহযোগিরা, লাশ কাটাই যাদের জীবিকা অর্জনের, বা বেঁচে থাকার উপায়। আমাদের আপন আলাপের ধারাবাহিকতায় আমরা গিয়েছিলাম নারায়ণগঞ্জ লাশকাটাঘরে আসলাম ডোমের কাছে। প্রথমত সে আমাদের সাথে আলাপে রাজি হতে চায়নি, উপরন্তু আমাদের সাংবাদিক ভেবে ধান্ধাবাজ আখ্যায়িত করে তাড়িয়ে দিয়েছিল। বেশ কয়েকবার। আমরা এরপর তাদের কলোনিতে যাওয়া শুরু করলাম। আমাদের মধ্যে সম্পর্ক ক্রমশ: সহজ হয়ে আসে। আর সে সমস্ত দিনের আলোচনার সারঅংশটুকু এ লেখায় হাজির করা হলো। তাদের মুখের ভাষাতেই। যদিও বাংলা তাদের মাতৃভাষা নয়। তবে যেদিন আমরা আলাপের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় পেলাম, তখন আসলাম তার সঙ্গিদের সাথে হেরোইনের নেশায় ঢুলছে। আসলামদের ঘরে আজকাল সন্ধ্যার পর এমন দৃশ্য অহরহই চোখে পড়ে। কেবল বাংলামদের নেশায় তাদের জীবনে সকল বেদনা-অপ্রাপ্তি-অবহেলাকে আজ আর আড়াল করা যাচ্ছে না। তাই কি এই ভয়ঙ্কর নেশার হাতে এমন করুণ সমর্পণ? সেই নেশালাগা ঘোরের ভেতর থেকে…
আমার বাবার নাম এমনি আছিল কুতুয়া। আসল নাম নন্দা নন্দ লাল সরদার। বাবায় আইছিল ইন্ডিয়ার মেদিনীপুরতে। এই ডোমের চাকরি দিয়া হেরে সরকার আনছিল, হেইডাতো অনেক আগে- পাকিস্তান পিরডে। দেখতে হোনতে খুব মোডা-সোডা আছিল। বাবায় এইহানে কাম করত ম্যালা আগেথাইক্কা। কত সালতে হেইডা কইতে পারতামনা। তবে আমি হ্যার লগে বিশ বছর থাইক্কা এই কাম করতাছি। ঐযে ঐ ছবিটা দেখতাছেননা, ঐডা অইল আমার বাবায়, আমরাত হের কিছুই পাই নাই, এহন খালি কামটাই করতাছি। আর ঐ যে ছবিটা দেখতাছেন- মইদ্যেরটা বাবায়, লগে আমরা বাইয়েরা। বাবার লগে আছি আমি, আর এই সাইডেরটা- এইযে প্যান্ট পরইন্নাডা, এই বাইডা আরায়া গেছেগা। ঐ যে আমার মাজারো মাইয়াডারে কোলে লইয়া ছবি তুলছে- মাইয়াডারে খুব আদর করত, অর নামে ব্যাংক ব্যালেন্স করছিল, বহুত কিছু করছিল।
ঐ বাইডার নাম আছিল রুস্তম-আর সরকারি খাতায় নাম আছে বুদ্ধু। উইয়ে আরাইয়ে এই আট-দশ বছর অইব, আল্লাপাক ওরে বাচায়া রাখুক। অর সাইন্সটা ইট্টু নষ্ট আছিল-লঞ্চেওে পইরা গিয়া মাথাত বারি খাইছে, কানে বারি খাইছেত-হের পর থাইক্কা ইট্টু কিমুন যানি অইয়া গেছিলগা।
এইহানে মেথর আছে কত ঘর কইতে পারতাম না, কয়েকশ ঘরত অইবই-ডোম আছে বত্রিশ ঘর। অনেকে গেছেগা, বালা কাম কেডা না চায়? এই হানে অরা যেই কাম করে তাতে চলে না বইল্লাইত যায়। আবার যিমুন কামাই করে হিমুন খরচও তো আছে। কেমনে খরছ করে? খরছের কি অবাব আছে-দরেন কাপর-চোপরের কতা, ইট্টু নেশা-পানি করতে খরছ আছে, খাওন-দাওনের খরছ আছে, আমোদ-আল্লাদে তো আছেই এই যে টিপি চলতাছে, ডিশের লাইন এই কলোনিতে আইছে তা আপনের আট-দশ বছর অইব-হগল ঘরে ঘরেঅই আছে। লাইন ভারা দুইশ ট্যাকা কইরা। আরে বাই এই সব কইয়া কোন লাব নাই, আপনেরা যেন এই দশজনের একজন মাস্টার আছেনা-ওনারে লগে লইয়া আইয়েন। যান-তো আপনে অহন খরছ করেন ৫০০ ট্যাকা। আমি আপনেরে সব কিছু কমু-চুপচাপ বইয়া থাকেন-
নেশা-হ. হগল পদের নেশাই পাওয়া যায়, এই যে খাইতাছি , এইটারে বাংলায় কয় হিরোইন,
আর কয় ডেরাগস! ইংলিশ। এইটাতো সব সময় খাইনা, শখের বিষয়ে খাই মাঝে মাঝে। দোস্তরা আহে, অগো লগে খাই। কলোনিতই পাওয়া যায়। দোস্তরা আহে, আরো কত মাইনষে এইহান থেইক্কা নিয়া যায়! কি কমু আপনেরে-কত লেখাপড়া জানা মানুষ আহে।
আরে বাবা, আমার আর কি কমু? আমি যুদ্দ দেখছি, সব মনে আছে। আপনে যুদ্দ দেখছেন? আমি যুদ্দ দেখছি, মানুষ জবা করতে দেখছি। যুদ্দ করি নাই, দেখছি আর্মিরা আছিল ঐ যে ঘাট আছে না- লঞ্চ ঘাট- ঐ হানে, আমরা এই জায়গায়ই আছিলাম, রাস্তাডা খুইদ্দা, যেইরম লাদেনে আর সাদ্দামে কেমনে গুহা বানাইছে হেইরহম গুহা বানাইছিলাম-এই সামনের রোডে, রোডটারে বিতরে। ৪০-৫০ খান মানুষ হান্দায়া দিলেও কুজতে পারতনা।
মদতো খাই, আপনেরা রাগ অইয়েন না, আপনেরা একটা মানুষ আমি মানুষ না? যহন আপনের শইল্লে আমি চাক্কু চালামু তহন একটা মায়ের ইষ্ট লাগেনা! মদ খাইলে চক্ষুটা অন্য সিস্টেমে থাকে। কত মাইয়া আহে- খারাপ- কালা মাইয়া থাইকা রূপসী বালা বালা মাইয়া থাকে-কত মাইয়া নষ্ট অইয়া যায়না-আমরা অই সাইন্সে কাম করিনা, আমরা সাইন্স পড়ি কোনটা-এই নারী কি কারণে মরছে, কিভাবে মরছে।
পরথম যহন লাশ দেখলাম কিমুন আর লাগব? লাশতো লাশই। মাইনষের লাশও যা মরা গরুও তা, মরলে আর হ্যার তফাৎ কি? কেন হ্যারে মারল, ক্যামনে মরল জানতে অইবনা? -বাবার লগে পরথম পরথম যহন যাইতাম খারাপ যে লাগতোনা তা না, ইট্টু ইট্টু লাগতো। -তয় ঐডাই যহন কাম, করতে তো অইবোই।
একবার মেডিক্যালের (ঢাকা মেডিক্যালে কলেজ) এক পর্ফেসার আমারে লইয়া গেছিল- আমারে ট্যাকা দিয়া- অইযে কসাইখানা আছেনা, কসাইখানা-গরু-ছাগল কাইট্টা কাইট্টা ঝুলাইন্না থাকেনা, ঐ হানেও মানুষ ঝুলাইন্না ঝুলাইন্না। ফিরিজ আছে কমছে কম ৫০ টা। আর এই হানে-কিছুই নাই, লাশ রাহনেরও কিছুই নাই। আমার কতাযা আমি ভাইঙ্গা কই, ডিসি এমপি চোর, সব চোর। চোর বোঝছেন? আপনে কেন ঢাকা যাইবেন কেল্লাইগা? সুযোগ সুবিদা আছেতো-আমি মানছি তো, ঢাকাতো সারা বাংলাদেশের মানুষ ঐহানে যাইত, তো অহনে ডিষ্টিকে বাগ কইরা দিছেনা-বরিশালে বরিশাল পড়ব, ঢাকার ঢাকা পড়ব, নারায়ণগঞ্জে নারায়ণগঞ্জের লাশ পড়ব।
বাই, আমি তো নিজের নাম সই করতে পারি না, সই করে তো দর্পনে, ছোড বাই। হেইডার লাইগাইতো অরে কামে ডুকাইলাম। সরকারি খাতাত অর নামঅই রইছে। বেতন পাই তিন আজার ট্যাকার মতো। বকশিশ? হেইডার কোন ইস্টিশান নাই। ১০০,২০০,৩০০। এমুনও আছে পাইনা, সব থাকেনা কিছু খরচাপাতি ও আছে। দরেন যারা লাশ কাটনের সময় লগে দরে হেগ কিছু দেওন লাগে, এইডা হেইডা কিনন লাগে। যেমন দরেন কালা কাইতন-সিলানের লাইগা, সাবান আবার মাল কিনতেও তো ট্যাকা দেয়।
আপনে আমার লগে যাইবেন? আপনেরে লাশের পার্ট বাই পার্ট দেহামু, পার্ট বাই পার্ট হিগায়া দিমু। আপনের বই-পুস্তকে আপনে পড়তাছেন, আর চউক্ষের দেহাই আর একটা। কত ডাক্তার ছাত্ররা আমাগো কাছে আহে হিগতে।
কাজের ব্যস্তর লাইগা পরতে যাই নাই, সত্য কইরা কই, আমি যদি পড়া লেখা করতাম-বাবায় মায় পাঠাইছে, আমি শয়তানিপনা করছি।
হ, লাশ কাটনের আগে-পড়ে সুবিদা মতন মোরগ ভোগ দেই। সবসময় কি আর নিয়ম মানতে পারি! আল্লার কাছে কই, আল্লা আমি ইট্টু উপরের দিকে উঠতে চাই। আপনেরে আমি বাংলা খাস কইয়া দেই। হে আল্লা, আমারে একটু উপরের দিকে নেন। আমি এই নামে দিলাম, আমি আপনের কাছে দোয়া চাই এমুন বোঝালেন।
আমি এহন বাঙ্গালি গো লগে চলি বইল্লা আল্লা করি। আমি ঈশ্বরে, ভগবানে ডাকি। আপনের মা ফাতেমা আমাগো কালী মা, আপনে যারে কন শেরে আলী আমরা কই হনুমানজী। কালী মায়েরে মানি, মা মনসা, দুগ্ গা আছে।
অনেক উৎসব অই্ত্ত করি, সব পূজাতোই এই হানে অয়। মন্দির আছে, দুগ্গা পূজা করলাম। এই ছাড়াও পয়লা বৈশাকে মিষ্টি-মুষ্টি আনলাম। বিরানী-পোলাও খাই। পোলাপানেরা নতুন কাপড়-চোপড় পিন্দে। কয়মাস আগে দর্পনরে বিয়া করাইলাম-অনেক মানুষরে খাওয়াইছি।
সাইনবোড তো একটা আছে-গেইটে, কি লেখা কইতে পারতামনা (জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ)। পবেশ নিষেদ? কইতে পারতাম না, তয় আপনেরা ডোকলেন ক্যামনে, আরো কত মানুষইত্ত আহে। আমাগো আলাদা কইরা রাখছে? কেমনে-মেথর আর ডোম, আমাগো ছাড়া কেউর উদ্দার আছে? আমরা অইলাম মাইনষের মইদ্দে সব চাইতে উঁচা জাত, আমাগো কাছে মরলে আইতেই অইবো-আমরাইত পার করি-আমাগো মরলে পোড়ায়, আর মন চাইলে আমারে মাটিও দিতে পারবো। বাবায়-মায় দুইজনরেই মাটি দিছি, হেরাই কইয়া গেছিল-আমার বাবার কবরটা কই আমি কইয়া দেই-গোরস্তান (মাসদাইর শ্মশান) যান, বিতরে ডোকতে বাম পাশে দেখবেন ছেট-ছোট একটা লেখা আছে ‘ওঁম’ ঐটা আমার বাবার কবর। আমার কি ইচ্ছা, হেইডা আমি মরতাছিনা-পোড়লে তো এক্কেবারে ছাই, সব শ্যাষ। আর মাটি দিলে দরেন ইট্টু চিহ্ন থাকে।
আরো বালা কাজ পাইলে তো করতামঅই। একটা কাজে লাগান আমারে, আপনেরে আমি সব কিছু কমু। এই আপনের অফিসের কাম আছেনা, অফিসের কাম। আপনে আমারে চাকরিটাত্ লাগায়া দেন, বেতন দুই আজার অউক, পনের‘শ-যাই অউক।
আমার দুই পোলা। বড়ডায় চাকরি করতাছে, পৌরসবায়-কিলিনারের। আমার বাবায় আমারে এই কামে আনছে, আমি অরে আমার লগে নেই না, অরও যাইতে মন চায়না। যা করতাছে করুক। ছোড বেলা ইস্কুলে গেছে, হালকা-পাতলা পড়ছে। লেখতে পড়তে পারে। এই কলোনীতে উইয়ে থাকতে চায়না। আমি আপনেরে যেইডা কইলাম-একটা অফিসে কাম থাকলে অর লাইগা ব্যবস্তা কইরা দিয়েন। আর যদি কোন অফিসের কামে পোষ্টিং অইলে অর ডোমের কতাডা কইয়েন না। ডোমের কামডা ছোড অইবো ক্যা, তাও মাইনষে জানলে যদি কিছু কয়!
মাইয়াডাওতো বড় অইছে, বিয়া দিতে অইবো। এইযে দেখতাছেন, এইডা বড় মাইয়া। আপনের সামনেইও আমার এক বইন-জামাইর লগে কতা কইলাম পোলা দেকতে। বালা পোলা পাইতে অইবো-জাতের পোলাতো লাগবই! দেহি কি অয়।
বাংলাদেশের বিতরে যারা এই কাম করে তারা সব আমাগো আত্মীয়। কোন বাইরের মানুষ করেনা। গোপালগঞ্জ কন, ফরিদপুর কন, মাদারীপুর, বরিশালÑ সবদিগেই আমাগো রক্তের হিসাব।
এইহানে যদি আর লাশ না আহে? এইডা কি আর অয়? দূর কি কন! কত দরনের মরন আছে! যদি না আহে তো হেইডা বালা কতা, আমরা আর কি কমু! তয় যদ্দিন মানুষ মরবো তদ্দিন আমরা আছি, হেইর পর নাঅয় অন্য কাম খুইজ্জা লমু।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : অজয় চৌধুরী ও শরীফ মহসীন
[লেখাটি সাহিত্য পত্রিকা ওঙ্কার-এর ২০০৪ দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত]
শাইলক কথা অমৃত সমান! – হাসান জাফরুল
মে ২৯, ২০২৫
রয়া ও নন্দিনী – নাদিয়া ইসলাম
মে ২৯, ২০২৫
বমি বিকার অথবা অকাল স্খলন – অমল আকাশ
মে ২৯, ২০২৫
ফাঁকি – আল-বিরুনী প্রমিথ
মে ২৯, ২০২৫
তুই কি বেঁচে আছিস? – অমল আকাশ
মে ২৯, ২০২৫