ওঙ্কার

তুই কি বেঁচে আছিস? – অমল আকাশ

Post Views16 Total Count
0Shares
অমল আকাশ

ইদানিং অফিসে ঢুকেই খবরের কাগজগুলো একসাথে নিয়ে বসে টেবিলে। তারপর সবগুলো পাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে রুটিন মাফিক একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে লিকার চায়ে চুমুক দেয় সে। না, ওর ছবি অথবা নাম-ধাম ছাপা হয়নি আজও। ওর কলিগ একদিন খুব করে বুঝানোর চেষ্টা করেছে, ‘আরে ভাই এতো ভয় পেলে বাংলাদেশে থাকতে পারবেন? আর আপনার যে ধরনের সমস্যা হচ্ছে, তাতে আমার মনে হয় একজন মানসিক ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিৎ।’ কলিগের কথায় ওর মনের আতঙ্ক বিন্দুমাত্র কমেনি সেদিন। আর তাছাড়া ও বোঝে, ওর কলিগ সরকারি দল করে বলে মৌলবাদ-ফৌলবাদ, এসব নিয়ে বিবিধ গলাবাজি করতে হয়। মুখে যত সাহসের কথা বলুক না কেন, সেদিন যখন অফিসের নিচে চায়ের দোকানটাতে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল, আর পাশের রাস্তায় পাবলিক বাসে দুম করে একটা পেট্রোল বোমা পড়লো, তখন সবার আগে ওর কলিগইতো সেখান থেকে দৌঁড়ে পালিয়েছিল। অথচ ও কিন্তু গাড়িটার দিকে ছুটে গিয়েছিলো। না, যাত্রীদের উদ্ধার করতে নয়। অতো করিতকর্মা বা সমাজসেবী সে নয়। বরং এ সমস্ত ঝুটঝামেলা পাশ কাটিয়ে চলতেই সে পছন্দ করে। গিয়েছিলো ঐ বাসে আহত বা নিহতদের মাঝে সে নিজে ছিলো কিনা তা দেখতে। তখনও কেউ পুরোপুরি মারা যায় নি। বাসটা দাউ দাউ করে জ্বলতে জ্বলতে বাতাসে চামড়া পোড়া গন্ধ ছড়াচ্ছে। আহতদের হাসপাতালে নেবার চেষ্টা চরিত্র চলছে। দমকল এসে পড়েছে আগুন নেভাতে। এতো যে হৈচৈ, চিৎকার, আর্তনাদ তার মাঝ থেকে ভিড় ঠেলে একটা কণ্ঠস্বর ওর খুব পরিচিত লাগছে। আহতদের একজনের যন্ত্রণাগ্রস্থ চিৎকার। আর কান্নার সেই চিৎকার ওর বুকে আচমকা এমন কামড় বসিয়ে দিল যে ভয়-আতঙ্কে হাত পা থরথর করে কাঁপছিলো। ‘এটা কি তবে আমি?’ ও জানে না আগুনে পোড়ার অনুভূতি কি। কিংবা চামড়া-মাংস পোড়ার যন্ত্রণায় কি ধরনের চিৎকার বেড়িয়ে আসতো এর কণ্ঠ থেকে।

ঐ লোকটাকেও ত্বরিৎ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল হাসপাতালে। সাথে সাথে ও ছুটলো। লোকটার চেহারা ভিড়ের মধ্যে ঠিকঠাক দেখা যায়নি। বার্ন ইউনিটে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত ওর আতঙ্কগ্রস্থ মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল, ঝলসে যাওয়া চিৎকারটা কি আমি ছিলাম? কিন্তু না, হাসপাতালে পৌঁছে ও আরো একটা দিনের মতো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারলো। লোকটার পাশে কান্নারত বৌ-বাচ্চাদের দেখে ও নিশ্চিত হলো, আগুনে পোড়া লোকটা সে ছিলো না।

ডাক্তার বললেন, ভয় নেই! আতঙ্কের সাথে থাকতে থাকতে একদিন আতঙ্কটা গা সওয়া হয়ে যাবে।

সে বলেছিলো, মানে, আগুনটাও আমার গা সওয়া হয়ে যাবে! পুড়লেও অতো কষ্ট পাবো না!

সরকার দলীয় কলিগ বললো, অ্যাডজাস্ট করতে পারছেন না যেহেতু, এককাজ করেন, বিদেশে চলে যান। আমাদের গভমেন্টতো খুবই অল্প টাকায় বিদেশে লোক পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে!

বিরোধীদলীয় কলিগ মাঝখানে ঢুকে পরে বললেন, আপনারা মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ…

টেবিল ছেড়ে সে উঠে আসলেও ক্লান্তিহীন সরকারি আর বিরোধীদলীয় বিতর্কটা চলতে থাকলো। ওর এসব রাজনৈতিক বিতর্ক একদম ভালো লাগে না। আরে ভাই আগুনটা কে লাগিয়েছে- আমি না তুমি এ বিতর্ক চলতে চলতে দেশটাতো পুড়ে ছাই হয়ে গেল। আগুনটা নিভাবে কে? যত্তোসব ফালতু লোক! এ জন্যই ও পৃথিবীতে সবচে বেশী ঘৃণা করে রাজনীতিকে।

আর তার মাকেও সে বুঝিয়ে পারে না, বাড়ি ফেরার আগ পর্যন্ত দুঃশ্চিন্তা করতেই থাকবে। আর ঘরে ঢুকতেই প্রায় দিনই বলবে, ‘আজ খবরে তোর মতো একটা ছেলেকে দেখলাম!’ যতই তাকে সে বলে না কেন, এই যে আমি বেঁচে ফিরে এসেছি বাড়িতে, আমি আগুনে পুড়িনি। ওটা অন্য কেউ ছিল। তবু আজকেও সে বাড়ি ফিরতেই একই গল্প জুড়ে দিলো। ওর ধারণা সারাক্ষণ খবর আর টকশো দেখে দেখে ওর মায়ের মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয় টেলিভিশনটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসে। কিন্তু পরক্ষণেই টের পায় টেলিভিশন ঘরে নিয়ে আসা যত সহজ, ঘর থেকে বের করা ততো সহজ কাজ নয়। কিন্তু তার মা তো এটা বোঝে না, মায়ের এমন আশঙ্কার কথা শুনলে ভয়-আতঙ্ক আরো বেড়ে যায়। সে বোঝানোর চেষ্টা করে মাকে যে, ও বাসের জানালার পাশে পারতপক্ষে বসে না। বসলেও জানালার সব কাঁচ যাত্রীরা সবাই ভয়ে বন্ধ করে রাখে। আর একান্ত যদি বাসে আগুন লেগেই যায় সেক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক কী করতে হবে, তা সে নেট থেকে ডাউনলোড করে শিখে নিয়েছে।

তবু মা আজ একটু বেশী আতঙ্কগ্রস্থ, ‘কিন্তু ছেলেটার নাম-ধাম সব তোর সাথে মিলে যাচ্ছে যে! আর এই দেখ, হাতের যে চামড়াটুকু এখনো পুড়ে যায়নি, সেখানে একটা পরিচিত দাগ। আমি তোর মা, আমি জানি এটা তোরই জন্মদাগ।’

এবার সে টিভির পর্দায় চোখ ফেরাতে বাধ্য হলো। হ্যাঁ, মায়ের বর্ণনা একদম ঠিক। ঝলসে যাওয়ার পরেও, ওর মনে হচ্ছে ছেলেটার চেহারার আদল ঠিক ওরই মতো। খবর বলছে, গতকাল আগুনে পুড়ে আজ ছেলেটা বার্ন ইউনিটে মারা গেছে। মুহুর্তে ওর ভিতরে হিমবাহ বইতে শুরু করলো। সমস্ত শরীর অসাড় লাগছে। হাত পা কাঁপছে ভীষণ। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছে না। সোফায় মায়ের পাশে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লো সে। সারারাত দুঃস্বপ্নে নিজেকে আগুনে পুড়তে পুড়তে দেখে, শরীরের চর্বি গলে গলে মাংসপেশী পুড়ে কাঠ কয়লা হতে দেখে দেখে সকালে বিছানা ছেড়ে প্রথমেই দৈনিক পত্রিকাটা নিয়ে বসলো। মনে মনে প্রার্থনা করতে থাকলো রাতে যা দেখেছে তা যেন দুঃস্বপ্ন ছিলো, সত্য নয়।

কিন্তু না পত্রিকায় ছাপানো বর্ণনার সাথেও ওর সব মিলে যাচ্ছে। অফিস থেকে ফেরার টাইম, ওরই অফিস রুটের বাস, মিলে যাচ্ছে এবার মিলে যাচ্ছে নাম-ধাম বয়স, চেহারার বর্ণনা সব সব মিলে যাচ্ছে। নিজের এমন অযথা মৃত্যু সে মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। ওর মতো একজন ছা পোষা, নিরীহ কেরাণী কেন মরবে আগুনে পুড়ে। মেনে নিতে পারছে না কিছুতেই। গতকাল আগুনে মরা ছেলেটা তবে ওই ছিলো! আর একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মাথার ভেতর, আচ্ছা ও যে আগুনে পুড়ে মরলো, তবে কোন যন্ত্রণা টের পেল না কেন? তবে কি ডাক্তারের কথাই সত্যি হয়েছিলো- আগুনটা ক্রমশ ওর গা সওয়া হয়ে গিয়েছিলো! শেষ পর্যন্ত একটা সান্ত¡নার ছায়া ওর চেহারায় নেমে আসতে থাকলে, মা এসে ওকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কালরাতে টিভি নিউজে কি ঠিকঠাক দেখেছিলাম? বাবা, তুই কি এখনো বেঁচে আছিস?’

Amal akash golpo[লেখাটি সাহিত্য পত্রিকা-ওঙ্কার ২০১৫ ফাল্গুন সংখ্যায় প্রকাশিত]

Amal akash
অমল আকাশ

গল্পকার, সংগঠক ও চিত্রশিল্পী। ফটোক্লিক : রিপন দাস

বিভাগ

কবিতা

error: Content is protected !!
We use cookies to personalise content and ads, to provide social media features and to analyse our traffic. We also share information about your use of our site with our social media, advertising and analytics partners. View more
Cookies settings
Accept
Privacy & Cookie policy
Privacy & Cookies policy
Cookie name Active

🍪 We Use Cookies

Our website uses cookies to improve your experience. They help us remember your preferences and analyze traffic. Some cookies are essential, while others help us optimize content. By continuing to browse, you agree to our use of cookies. You can manage cookie settings in your browser.

Save settings
Cookies settings
Scroll to Top